Search Abu Bokkar Siddik Official Blog

Thursday, January 14, 2021

সৈনিক জীবন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী

 সৈনিক জীবন 



সিভিলে সমাজে উনাদের সাদা-মাটা চলা-ফেরা, আচার- আচরণ দেখে অনেকেই নাক সিঁটকান। অনেকেই মনে করেন সৈনিকরা অামাদের চাইতে অনেক বোকা। অনেকে আর এক কদম আগ বাড়িয়ে বলেন, সৈনিকরা সব পাগল। কিন্তু সৈনিকরা কি আসলেই আপনার ভাবনার মত?

কখনওই নয়। বরং সৈনিকরা আপনাদের চাইতে অনেক ট্যালেন্টেড। হাজার হাজার চৌকস তরুণের মধ্য হতে সেরা তরুণদেরকে বাছাই করে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করানো হয়। তাদের বাইরের অংশকে দেখে ভিতরটা অনুমান করা কঠিন। কারণগুলো নিম্নরূপ-

প্রত্যেকটা সৈনিক এক একটা মহাকাব্যের নায়ক। তাদের গল্প গুলি পাঁচ তালার অালিশান ফ্ল্যাট হতে শুরু হয় না। তাদের গল্পগুলি শুরু হয় শীতের মাঝ রাতে কনকনে ঠাণ্ডা আর কুয়াশার আবরণে দাঁড়িয়ে ডিউটিরত অবস্থায়।

তাদের গল্পগুলি কেউ লিখেনা, কারন তাদের গল্পে মুগ্ধ হবার কিছু নেই। আশ্চর্য হবেন না। নিম্নবিত্ত পরিবার হতে উঠে আসা এই মানুষগুলির মনটা কত বড়! নিজের জীবনটা শুধু দেশের নামেই লিখে দেয় না, লিখে দেয় পরিবারের নামেও। সময় দেয় দেশকে আর অর্থ দেয় পরিবারকে। এদের নিজের কিছুই নেই। পরিবারের চাহিদা পূরণ করতে করতে নিজেদের চাহিদা ভুলে যায়। কত অজস্র মাইল হেঁটে চলেছে, কিন্তুু একশ কদম দূরে থাকা সুখ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। জীবনটা একটা সংরক্ষিত গণ্ডির কাঁটাতারে আঘাত খেতে খেতেই শেষ হয়ে যায়।

যারা দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়ে যায়, তাদের স্বাধীনতার গণ্ডিটা কত ছোট! ডিউটি পোস্ট হতে পাঁচ কদম দূরে খোলা স্থানে যেতে পারেনা।

কষ্ট লুকানো হাসিমুখটা দেখেছেন, মনের ভিতরে কষ্ট জমানো মলিনমুখটা দেখেন নি (কারণ হয়তো তার বোনের সেদিন বিয়ে ছিলো ), কাজের জন্য সে ছুটি পায় নি।

১৬ই ডিসেম্বরের জাতীয় কুচকাওয়াজের ড্রিল দেখে মুগ্ধ হন, কিন্তু জানেন না, দিন রাতে ১৮ ঘন্টা করে তাকে কতবার কতভাবে রগড়ানো হয়েছে, ড্রিলের ছন্দ মেলানোর জন্য।

বর্ডারে গুলাগুলির ঘটনার খবরে গরম হয়েছেন, নতুন কোন দৃশ্যের অবতারণায়, কিন্তু জানেন না সেই সময় ডিউটিতে থাকা সৈনিকটার কানের পাশ কেটে যাওয়া বুলেটের শোঁ শোঁ শব্দের আতঙ্কিত বাতাসের প্রবাহ কেমন লাগে।

আনস্মার্ট, গেঁয়ো সৈনিকদের দেখে বিরক্ত হন, ঢলঢলে শার্ট, বেঢপ আকৃতির প্যান্টের ইন করা দেখে মুচকি মুচকি হাসেন, কিন্তু কখনো কি বুঝেছেন, আপনার শরীরে যে পোশাকটা জড়িয়ে আছে, তাতে তাদের কৃতিত্বটাও জড়িয়ে আছে? নইলে কবেই সাদা কাফনে জড়িয়ে কবরে শুয়ে থাকতেন!

বাইরে হোটেলে তাদের বুুভুক্ষের মতো খেতে দেখলে লজ্জাহীন হাসি দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নেন, কিন্তু জানেন কি, সেই সৈনিকটা একমাস পর টাটকা খাবার খেল! দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় মাসের পর মাস ডিউটি করে ফ্রিজিং করা খাবারটা একবার খেয়ে দেখেছেন কি?

ক'একটি টাকা কমানোর জন্য দোকানদারের সাথে দামাদামি করতে দেখলেই ভাবতে পারেন, কত ছোট লোকরে বাবা। আপনি কি জানেন, তার শরীর ঘামা অল্প কিছু বৈধ বেতনের টাকাতে তাকে তার বাবা-মা, নিজের স্ত্রী-সন্তানদের ভরণ পোষণ, সন্তানদের পড়াশুনা, বাসা ভাড়া, সবার খাবারের ব্যবস্থা করে কিভাবে চলতে হয়?

দশ টাকা রিক্সা ভাড়া বাঁচাতে সে প্রতিদিন পায়ে হেঁটে চলে। মাঝরাতে যখন আপনি কম্বলের নিচে আরেকটু আরামের জন্য গুটি মেরে শুয়ে থাকেন, তখন সে ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে উঠে পায়ে বুট পরে, আপনারই শান্তির নিদ্রাকে ত্বরান্বিত করতে। কারণ তার ডিউটির সময় হয়ে গেছে। 

গরমের দিনে আপনি এসি ছেড়ে, কয়েল জ্বালিয়ে মশারি টানিয়েও বলেন, কত মশা? সে তখন ঝোঁপের পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অজস্র মশার কামড় সহ্য করে দুই তিন ঘন্টা কাটিয়ে দিচ্ছে।

সে সবাইকে নিরাপত্তা দেয়, কিন্তু তার নিজেরই নিরাপত্তা নেই। সময় অসময়ে কর্মসম্পাদনের দুর্ঘটনায় শত্রুপক্ষের একটি মাত্র বুলেট এসে কখন যে তার জীবন প্রবাহ নিভিয়ে দিয়ে যায়, সে চিন্তা তার অন্তরে থাকে না।

সন্ধ্যা রাত হতে শুরু করে ভোর পর্যন্ত বাংকার আর ট্রেঞ্চ খোঁড়ার পরও ২০ কিলোমিটার পাঁয়ে হেটে মহড়া দিতে যায়। তার শরীরের প্রতিটা পরতে পরতে ক্লান্তি। রোমান্টিকতা আসবে কোথা হতে! এটাই হলো সৈনিক জীবন।

বেলা শেষে যখন আপনি প্রেয়সীর সাথে আড্ডা দিয়ে ফিরেন, সৈনিকরা তখন সারা শরীরে লেগে থাকা ঘামকে শাওয়ারের নিচে দাড়িয়ে পরিস্কারে ব্যস্ত থাকে।

কথার ছলে একটা কথা সৈনিকরা প্রায়ই বলে থাকে, তাদের পা নাকি প্রতিদিন আল্লার কাছে প্রার্থনা করে বলে "হে আল্লাহ! আর যদি পুনর্জন্ম হয়, তবে সৈনিকের হাঁটুর নিচে আমারে যোগ করে দিওনা"।

হাজার হাজার ফোসকা পড়ে সেটা আবারও গলে গিয়ে শক্ত হয়ে যাওয়া পা গুলি দেখলে আপনার মনে প্রেম আসবে না। তার জীবনের গল্প আছে। কিন্তু বাস্তবতার কষাঘাতে সেগুলি ধূসর অন্ধকার। কতটা সংকীর্ণতা নিয়ে তাকে বাঁচতে হয়, সে আপনাদের কল্পনারও বাইরে।

সৈনিকরা প্রতিদিন মরে নিজের ভিতরে। তার বুকের রক্তক্ষরণ কেউ বুঝবে না। তার সাক্ষী হল তার একাকিত্ব। ইউনিফর্মের জৌলুসে মুগ্ধ হন, কিন্তু তার নিচে যে প্রাণটা আছে, সেটিকে কেউ বুঝতে পারবেন না। 

জন্ম হবার তিন মাস পর সুযোগ হয় নিজের সন্তানকে দেখার। কিছু লেখাকে কখনো গুছিয়ে প্রকাশ করা যায় না, আমিও এই কথাগুলি এত বছর ধরে নিজের মনের ডায়রীতে লিখছি, কিন্তু গুছাতে পারি নি। এলোমেলো হয়ে যায়। কিছু লেখার ভিতর অমিলটাও তার সৌন্দর্য।

ছুটি শেষে ব্যাগ কাঁধে ফিরে ফিরে দেখা দাঁড়িয়ে থাকা তার প্রিয় মানুষটার মুখ, আত্মদহন, একাকিত্ব, শারীরিক ও মনসিক যন্ত্রনা, এটাই সৈনিক জীবনের নিত্যসঙ্গী।

এত কিছুর পরেও তারা গর্বিত, কারণ কোন বাঁধাই তাদের গৌরবকে মলিন করতে পারেনা। তারা দুর্বার, তারা যোদ্ধা।।।।

কাদামাটি আর অপারেশন এক্টিভিটিতে ক্ষতবিক্ষত পা নিয়েও তারা চলমান। তাদের সাথে ভোর চলে সূর্যাস্তের সন্ধানে, আর সন্ধ্যা চলে সূর্যোদয়ের অপেক্ষায়।

পথে পথে রাস্তায় রাস্তায় পায়ে পায়ে হেঁটে যায়। তারা যে ভাই পথের পথিক, পথ ছেড়ে কোথায় যাবে?

"নেইকো পথক্লান্ত, পা যুগল 
সময় ফুরালো পথে-ঘাটে,
পাথর ভাঙ্গছি অবেলা, আধাবেলা।। 
উড়িয়েছি ধূলো স্বপ্ন চতুরছায়া। 
নদীর উপকন্ঠ চিরে ফিরতি হাওয়ায় 
ফিরছি ধূলো প্রলয় ডাকা বালু ঝড়ে।।
আশায় দ্বীপ জ্বেলে জেগেছি
বুকের দীর্ঘশ্বাস চেপে 
রেখেছি অায়তবক্ষে, ছুটি শেষে 
আসার সময় চেয়ে দেখেছি 
প্রিয়জনদের অশ্রুসজল চোখ।।"

তাই তো তারা সিভিল সমাজের কূটচাল বোঝে না, বোঝে না ছলচাতুরী, ঠক-বাটপারী, জানে না প্রতারণা, করতে পারে না বাহানা। রাজনীতির ছলা-কলা সম্পর্কে অজানা, স্বার্থের বেড়াজালেও ন্যায়নীতিকে ভোলে না,

এটাই তো হল আমাদের সৈনিকদের মূলমন্ত্র!



সৈনিক জীবন
সৈনিক আবু বক্কর সিদ্দিক
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী